আগমনী

দেখে আয় তোরা হিমালয়ে, ও কি আলো ভাসে রে, উমা আমার আসে বুঝি, উমা আমার আসে রে‍— বাঙালির প্রাণের এই সুর, এই আগমনী শারদ আকাশে ভেসে আসে, শেষ বর্ষণের মেঘমল্লার মিলিয়ে যেতে না যেতেই৷ এই আগমনী অন্তরে বাহিরে মহাশক্তির অকালবোধনের আবাহনী৷ শারদ মহালক্ষ্মীর আবাহনে আকাশ ও মাটিতে এই সুরে যে মিলনের সুর বেজে ওঠে, সেই সুরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা মাটিতে নেমে এসে শ্বেতশুভ্র কাশফুলের রূপ ধরে৷ মানস কৈলাসের সুউচ্চ চূড়া থেকে অবতরণ করে অধরা চিন্ময়ীও ধরা দেন মর্ত্যের মৃন্ময়ীরূপে৷ ধ্যানপ্রতিমা দেবীর আবাহন ও প্রাণপ্রতিমা কন্যার আগমনের ঐকতানেই বেজে ওঠে আগমনী৷

যা কিছু বড়, যা কিছু মহৎ মানবমনকে আলোড়িত করেছে, তার মধ্যেই সে আবিষ্কার করেছে তার আরাধ্য দেবতাকে৷ কিন্তু এই দেবতাকে দূরে সরিয়ে রেখে সে শান্তি পায়নি, প্রাণের আবেগ পেতে চেয়েছে একান্ত আপন করে নিজের গৃহকোণে, মনের মণিকোঠায়৷ মার্তণ্ডের প্রলঙ্করী অগ্নিতাণ্ডবের বিচ্ছুরণ থেকে চয়ন করেই জ্বালিয়ে তুলেছে সন্ধ্যাদীপের শিখা৷ অনির্বচনীয়কে আপন দেবতার মধ্যে প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে পেতে চেয়েছে একেবারে বুকের কাছটিতে৷ অন্তরের আকুতিতে বলে উঠেছে, ‘আর পাব কোথা, দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা৷’

আমাদের অস্তিত্বের মূলে যে অসহায় জন্ম, তাকে সম্ভাবনা থেকে সম্ভব করে তোলে যে মাতৃশক্তি, যার লালনে অব্যক্ত থেকে প্রকটিত হয়ে চলেছে বিশ্ব চরাচর, তাকেই বোধের দীপ্তিতে মানুষ পেতে চেয়েছে জগন্মাতারূপে৷ আকুল চিত্তে বারবার নমস্কার করে উচ্চারণ করেছে সেই ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা৷’ এই মাতা শুধু জনয়িত্রী ও পালয়িত্রী নন, তিনি বরাভয়দানকারী রক্ষাকর্ত্রী, শরণাগত সন্তানকে রক্ষা করার জন্যে অশুভের বিরুদ্ধে খড়গধারিণী৷ আর কে না জানে, কী লৌকিক আর কী আধ্যাত্মিক জগতে, চেতনা উন্মেষের পূর্বে সকলেই, না জেনে মায়ের শরণাগত ও আশ্রিত৷

অসীম আকাশ যেমন তার সমস্ত মহিমা নিয়েই ধরা দেয় ক্ষুদ্র ঘটের গণ্ডীতে, অরূপ ধরা দেয় রূপের সীমানায়, জগন্মাতার বিরাটত্বকে বরণ করতে হয় আমাদের ধারণার মাতৃমূর্তিতে৷ সেই মাকে আমরা আহ্বান জানাই আমাদের হৃদয়ের আসনে, আমাদের জীবনের সুখদুঃখের মালা গেঁথে‍৷এই জীবনের মালা গাঁথতে গিয়েই কখন অজান্তে আবার আকাশ ও মাটির মিলন হয়, লৌকিক-অলৌকিকের দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়, জীবনের হাত ধরে জীবনাতীত মূর্ত হয়ে ওঠে৷

উপনিষদ বলেছে, ‘কোহ্যবোন্যাৎ কঃ প্রাণাৎ যতেষ আনন্দো না স্যাৎ৷’ আকাশে আনন্দ না থাকলে কে-ই বা এ জগতে প্রাণধারণ করার চেষ্টা করত! আনন্দের এই ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্যেই সমস্যা ও বিঘ্নসঙ্কুল জীবনে আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে মাতৃশক্তির বরাভয়৷ তাই তো বারেবারে তাঁর ব্যাকুল আরাধনা এবং প্রয়োজনে অকালবোধন শ্রীরামচন্দ্রের মতো পরিত্রাণের আশায়৷

শরতের অকালবোধনে উদ্ভাসিত দেবী দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আদ্যশক্তি মহামায়া অসুরশক্তির বিনাশে, শুভশক্তির উদ্বোধনে বারবার আবির্ভূতা৷ মধুকৈটভবধে ব্রহ্মা তাঁকে‍ আহ্বান করেছেন, মহিষাসুরবধে ও শুম্ভনিশুম্ভবধে দেবতারা স্মরণ করেছে, শত্রুজয়ে সুরথরাজা ও সমাধি বৈশ্য অর্চনা করেছেন, রাবণবধে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর আরাধনা করেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন তাঁর স্তবগানে মুখর হয়েছেন ও সফল হয়েছেন৷ তিনি সুখদা ও মোক্ষদা, যিনি সুখ চান তাঁকে‍ ভোগৈশ্বর্য দান করেন, যিনি মোক্ষ চান তাঁর মুক্তি বিধান করেন৷ ভক্তের অন্তর্লোকে তিনি শুভাশুভের দ্বন্দ্বে শুভকে জয়তিলক পরান৷

অবাঙমানসগোচর ব্রহ্ম যে তিনটি শক্তির দ্বারা জগৎ লীলায়িত করেন, সেই জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও ক্রিয়াশক্তির একই অখণ্ড প্রকাশের নাম চণ্ডী৷ চণ্ডী কোপময়ী দেবী, তিনি অসুরদলনী ও পাপসংহারকারিণী৷ কিন্তু সাক্ষাৎ এই ‘মহদ্ভয়ং বজ্রসমুদ্যতম’ চণ্ডীরূপী শক্তির মহাপ্রকাশকে ধারণা করা সাধারণী সীমায় সাধ্যতীত৷ কিন্তু অসীম আকাশ যেমন তার সমস্ত মহিমা নিয়েই ধরা দেয় ক্ষুদ্র ঘটের গণ্ডীতে, অরূপ ধরা দেয় রূপের সীমানায়, জগন্মাতার বিরাটত্বকে বরণ করতে হয় আমাদের ধারণার মাতৃমূর্তিতে৷ সেই মাকে আমরা আহ্বান জানাই আমাদের হৃদয়ের আসনে, আমাদের জীবনের সুখদুঃখের মালা গেঁথে‍৷

এই জীবনের মালা গাঁথতে গিয়েই কখন অজান্তে আবার আকাশ ও মাটির মিলন হয়, লৌকিক-অলৌকিকের দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়, জীবনের হাত ধরে জীবনাতীত মূর্ত হয়ে ওঠে৷ আকুল চিত্ত ধ্যানের ধনকে প্রাণের জন বলে বরণ করে নেয়৷ মনের গহনে অন্তঃসলিলা ধারার মতো কখন সামাজিক জীবনের বেদনাবিধুর কান্না আরাধনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়৷ ভক্তের আকুতি কখন মিশে যায় বিবাহিতা কন্যাকে ফিরে পাওয়ার আকুল আর্তিতে৷

জগদীশ্বরী কখনও কন্যারূপে রামপ্রসাদের বেড়ার ধারে, একেবারে ছোট, একান্ত আপনার হয়ে হাজির হন৷ সাধক কবির দৃষ্টিতে লৌকিক জীবনের বাৎসল্য রসের ফল্গুধারা ভক্তিসাধনার বাৎসল্যভাবের মোহনায় পূর্ণতা লাভ করে৷ কবির সেই উপলব্ধি আগমনীর সুরে গেয়ে ওঠে, ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, মা আমার কত কেঁদেছে৷’ ‘বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া’— এই গান জ্ঞানের গান, এ গান ভক্তির গান, এ গান মনের গান, এ গান প্রাণের গান৷ তাই দেবী ও মানবী, মাতা ও কন্যা, চিন্ময়ী পুত্তলি ও প্রাণপুত্তলির প্রেমে পাগল সাধক কবি আগমনীর সুরে গেয়ে ওঠেন—

‘কোলে আয় না ভবদারা নয়নতারা,

নাই মা আমার নয়নের তারা৷

যারা তারা চায়, আমার মত হয় কি তারা?

বিধাতারে আরাধিব মা, তোর মা আর না হইব,

এবার মেয়ে হয়ে দেখাবি, মায়ের মায়া কেমন ধারা৷’